মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিনই চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতীয় নানা পণ্য আসছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। মাঝে-মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কিছু কিছু পণ্য আটক হলেও চোরাকারবারীরা রয়ে যাচ্ছে অধরা। সম্প্রতি চোরাচালান তৎপরতা এমনভাবে বেড়েছে যে, মনে হচ্ছে সীমান্ত এলাকাগুলো চোরাচালানের অভয়ারন্যে পরিণত হয়েছে।
১২টি উপজেলা নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা গঠিত। এর মধ্যে ৬টি উপজেলাই ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা। এগুলো হচ্ছে ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর। উপজেলা গুলোর ১২০ কিলোমিটার হচ্ছে সীমান্ত এলাকা। এই ৬ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দিনে ও রাতে কৌশলে নানা পন্য ও মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে ঢুকছে। আবার বাংলাদেশ থেকেও কিছু পন্য ভারতে যাচ্ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হওয়া উল্লেখযোগ্য পন্যের মধ্যে রয়েছে চিনি, গরু,মহিষ, কয়লা, চুনাপাথর, শাড়ি, লুঙ্গি, কসমেটিকস, মোবাইল ফোন, মদ, গাজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ।
তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড় বিওপি, চানপুর বিওপি, ট্যাকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ি, ট্যাকেরঘাট বিওপি,বালিয়াঘাটা বিওপি, চারাগাও বিওপি এবং বীরেন্দ্রনগর বিওপি নিয়ন্ত্রিত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাকি দিয়ে প্রতিনিয়ত ভারত থেকে প্রকাশ্যে বাংলাদেশে আসছে শত শত কোটি টাকার চোরাই কয়লা, চুনাপাথর, আমদানি নিষিদ্ধ ভারতীয় নাসিরুদ্দিন বিড়ি, বিভিন্ন ব্রান্ডের মদ,গাজা, বিয়ার, হেরোইনসহ জীবন বিধ্বংসী মাদকদ্রব্য। তাছাড়া আরো আসছে শাড়ি-কাপড়, চিনি, থ্রি-পিছ, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ, প্রসাধনী সামগ্রী, গরম মসলা, কাঠ, গরুসহ বিভিন্ন সামগ্রী। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হচ্ছে সার, ডিজেল, কেরোসিন, মাছ, চাউল। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার পণ্য নির্বিঘ্নে পারাপার করছে চোরাকারবারিরা। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন নীরব থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাচালানীরা। এই সীমান্ত এলাকা এখন চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এলাকাবাসী বলছে, প্রশাসনের সহযোগিতায় এই বৃহৎ চোরাচালান সংগঠিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সীমান্ত এলাকায় প্রতিদিন রাতে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ভারত থেকে প্রতিনিয়ত কয়লা, চুনাপাথর চিনিসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য পাচার করছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব চোরাই পন্য আনতে গিয়ে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। সম্প্রতি চোরাই পথে কয়লা আনতে গিয়ে লাউড়েরগড় সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় এক যুবক, এরপর গত ৫ই আগষ্ট চোরাই পথে কয়লা আনতে গিয়ে কয়লা কোয়ারিতে পাথর চাপায় মৃত্যু হয় ১নং শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের লাকমা গ্রামের আব্দুন নূরের ছেলে আক্তার হোসেন (১৮) নামের আরেক যুবকের। গত কয়েকদিন আগে জঙ্গলবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাই পথে কয়লা আনতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয় সানবাড়ি গ্রামের এক যুবক এবং ০৩/১০/২৩ ইং রোজ মঙ্গলবার চোরাই পথে কয়লা আনতে গিয়ে বিএসএফের তাড়া খেয়ে পাথর চাপায় গুরুতর আহত হয় রজনীলাইন গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে আসগর আলী(৩৮)। এর আগে ২০২২ সালে ভারত থেকে চোরাই পথে কয়লা আনতে গিয়ে কয়লার গুহায় মাটি চাপা পড়ে ৩ বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে ৫ বাংলাদেশী যুবক আটক হয়। গত তিন/চারদিন আগে বড়ছড়া সীমান্ত এলাকার বড়ছড়া মন্দির কমিটির সদস্য মনি লালের ছেলে নির্মল, শুভ পালের ছেলে উৎপল, তেলিগাও গ্রামের রাকেশ পালের ছেলে যিশু ও ভারতে মুরগ পাচারকারী লোকেশ অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করে পূজার জন্য চাঁদা কালেকশন করে। পরবর্তীতে মদ খেয়ে মাতলামি করার অপরাধে বিএসএফের বেদম প্রহারের স্বীকার হয়।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকাগুলোতে চোরাচালান এখন নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। রাত দশটার পর থেকেই সীমান্ত এলাকাগুলোতে প্রায় শখানেক চোরাই কয়লা,চুনাপাথর ও চিনির নৌকা লোডিং শুরু হয়। ভোর পর্যন্ত চলে সিরিয়াল মাফিক একটার পর একটা নৌকার লোডিং। ট্রলার ও ট্রলির শব্দে ঘুমাতে পারেনা এলাকার লোকজন। চোরাচালান এখন আর চোরাইপথে হয়না, চোরাচালান এখন ওপেন চালানে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের ৫ কিলোমিটার এলাকা এখন চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় দিনে-রাতে যখন-তখন এপারের মাল ওপারে ও ওপারের মাল এপারে পাচার হচ্ছে নির্বিঘ্নে। পুলিশ এবং বিজিবির লাইনম্যান নামধারীরা চোরাচালানিদের থেকে প্রকাশ্যে বখরা আদায় করে চোরাচালানে সহায়তা করে থাকে।
সীমান্তের লাউয়ের গড়, চানপুর, রজনীলাইন, বুরুঙ্গাছড়া, বড়ছড়া, ট্যাকেরঘাট, লাকমা, লালঘাট, চারাগাও, কলাগাও, জঙ্গলবাড়ি, লামাকাটা, বীরেন্দ্রনগর এলাকার কিছু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিদিন সীমান্ত এলাকার কয়েক হাজার শ্রমিক এই সীমান্তগুলো দিয়ে ভারত থেকে শত শত মে.টন কয়লা, চুনাপাথর এবং চিনি চোরাই পথে নিয়ে আসছে বাংলাদেশে। এই কয়লার বস্তার ভিতরে থাকছে গাজা, মদ, ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার জীবন ধ্বংসকারী মাদকদ্রব্য। এই পাচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা নিজেরাও মাদকাসক্ত। তারা মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন মাদক যেমন-ইয়াবা, মদ, হেরোইন, রিকোডেক্স তাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় তারা সহজে মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে।
গত দশ বছর ধরে এখানকার মাদক ও বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য পাচারের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে বিজিবি ও পুলিশের লাইনম্যান পরিচয়ধারী কয়েকজন ব্যক্তি। তাদের সাথে রয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তার ভালো সম্পর্ক। বিজিবি ও উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সবার মাথার উপর ছড়ি ঘুরিয়ে নির্বিঘ্নে প্রতিরাতে কোটি কোটি টাকার পণ্য পারাপার করছে তারা।
চোরাচালানের ব্যাপারে তাহিরপুর থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি সদ্য এ থানায় যোগদান করেছি। সবকিছু এখনো ভালোভাবে জানিনা। পর্যবেক্ষণ করছি সবকিছু। আমার থানা এলাকায় কোন ধরনের চোরাচালানকে প্রশ্রয় দেওয়া হবেনা। পুলিশের সোর্স পরিচয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি খবর নিয়ে দেখবো এবং যে বা যারাই এটার সাথে জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলা বাজারসহ আরো কিছু সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতি রাতে রাতে গরু মহিষের চালান আসছে । এগুলো আবার ট্রলার বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। জেলার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচারকৃত এসব অবৈধ মালামাল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডেলিভারি করতে গিয়ে প্রায় সময়ই জেলা পুলিশ, র্যাব ও ডিবির হাতে ধরা পড়ছে প্রচুর পরিমাণ চোরাচালান পণ্য ও আসামী। এর পর ও থেমে নেই চোরাচালান। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচালিত হয়ে আসছে এমন কর্মকান্ড। গরু মহিষ চোরাচালানে বাজারের ইজারাদাররা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, জেলায় কর্মরত র্যাব-৯ সিপিসি ৩, পুলিশ ও ডিবি এ পর্যন্ত যতোগুলো মাদক সংক্রান্ত অভিযান চালিয়েছে তার প্রায় প্রতিটিতেই আসামীসহ মাদকদ্রব্য আটক করতে সক্ষম হয়েছে তারা। কিন্তু বিজিবির বেলায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিজিবি মাঝেমধ্যে লোকদেখানো কিছু কিছু মাদকদ্রব্য ও চোরাই পন্য আটক করলেও রহস্যজনক কারনে চোরাচালানীদের আটক করতে ব্যর্থ হন তারা। তাদের সামনে দিয়ে চোরাচালান পণ্য প্রতিদিন এদেশে নামছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স‚ত্র জানায়। বিজিবির মিডিয়া সেল হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বিগত ২ বছরের অভিযানে প্রায় সকল মাদকদ্রব্যই পরিত্যক্ত অবস্থায় আটক করা হয়েছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর জেলার দোয়ারাবাজার থানা পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে ৩৬ টি গরুসহ ৮ চোরাকারবারীকে আটক করে। ২৫ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ সদর থানা পুলিশ সুরমা নদীতে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় ১২টি মহিষ ভর্তি একটি ট্রলারসহ ৪ চোরাকারবারীকে আটক করে। এ সময় আটককৃতরা জানায়, জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলাবাজার সীমান্ত এলাকা দিয়ে এগুলো আনা হয়। এভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধ গরু মহিষ এনে বোগলাবাজারের ইজারাদার মো. রফিক হোসেনের মাধ্যমে ভুয়া ইজারার কাগজপত্র তৈরি করে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে পাঠাচ্ছে।
বিশ্বরপুর থানা পুলিশ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২১ বোতল মদসহ দুই জনকে আটক করে। ২৯ সেপ্টেম্বর দোয়ারাবাজার থানা পুলিশের অভিযান চালিয়ে ৩৬ বস্তা চিনিসহ একজনকে আটক করে। ১ অক্টোবর মধ্যনগর থানা পুলিশ ২২শ' কেজি চিনিসহ এক চোরাকারবারী আটক করে। ঐদিনই দোয়ারাবাজার থানা পুলিশের হাতে ২০টি ভারতীয় মহিষ আটক হয়। একই দিনে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ চিনি বোঝাই একটি পিক আপ আটক করে। ২রা অক্টোবর দোয়ারাবাজার থানা পুলিশ ৭১ টি গরুসহ এক চোরাকারবারীকে আটক করে। ৫ অক্টোবর তাহিরপুর থানা পুলিশ টেকেরঘাট সীমান্ত এলাকা হতে ২২৫ পিস ইয়াবাসহ একজনকে আটক করে।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান(পিবিজিএম) জানান, এসব সীমান্ত এলাকায় কাঁটা তারের বেড়া না থাকায় এবং দুর্গম ও বিশাল এলাকা হওয়ার কারনে বিজিবির সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব চোরাচালান পন্য আসে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ বলেন, জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে আসা ভারতীয় নানা পন্য আমরা প্রচুর পরিমাণে আটক করছি। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সুনামগঞ্জ নৌ পুলিশের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আতাউর রহমান বলেন, ভারত থেকে নৌ পথে যাতে কোন অবৈধ পণ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে না আসে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।